চীন থেকে খেলনা আমদানির আগে যা জানা জরুরি: কেনার আগে কী দেখবেন?

আমাদের শিশুদের জন্য খেলনা কিনতে গিয়ে আমরা প্রায়শই বিভিন্ন ধরনের চীনা খেলনার সম্মুখীন হই। এর কারণ হলো, বিশ্বে খেলনার সবচেয়ে বড় উৎপাদক এবং রপ্তানিকারক দেশ হলো চীন। দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় এই খেলনাগুলো আমাদের দেশেও বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু সব চীনা খেলনাই কি নিরাপদ? ক্ষতিকারক রাসায়নিক বা ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইনের কারণে শিশুদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে এমন সম্ভাবনা কতটা? এই প্রশ্নগুলো সব বাবা-মায়ের মনে আসা স্বাভাবিক।

আসুন, জেনে নিই চীন থেকে আমদানি করা খেলনা কেনার আগে আপনার কী কী বিষয় জানা প্রয়োজন:

 

১. নিরাপত্তার মানদণ্ড (Safety Standards):

 

সব দেশের মতো চীনেও খেলনার জন্য নিজস্ব নিরাপত্তা মানদণ্ড (যেমন GB 6675) রয়েছে। তবে বিশ্ববাজারে যখন খেলনা রপ্তানি করা হয়, তখন আমদানিকারক দেশের মানদণ্ড (যেমন ইউরোপের জন্য CE Marking, EN71; যুক্তরাষ্ট্রের জন্য CPSIA, ASTM F963) মেনে চলতে হয়। এই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডগুলো খেলনার রাসায়নিক উপাদান, যান্ত্রিক ও ভৌত বৈশিষ্ট্য, দাহ্যতা এবং লেবেলিংয়ের মতো বিষয়গুলো পরীক্ষা করে।

  • CE Marking (Conformité Européenne): ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বিক্রির জন্য এই মার্কিং থাকা বাধ্যতামূলক। এটি বোঝায় যে খেলনাটি ইইউর নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত সুরক্ষা মানদণ্ড মেনে তৈরি করা হয়েছে।
  • ASTM F963 (USA): এটি আমেরিকার খেলনা নিরাপত্তার জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড।
  • EN71 (Europe): এটি ইউরোপের খেলনা নিরাপত্তা স্ট্যান্ডার্ডের একটি সিরিজ, যা শারীরিক, রাসায়নিক এবং দাহ্যতা বিষয়ক পরীক্ষা করে।

কীভাবে দেখবেন: খেলনার প্যাকেজিংয়ে এই ধরনের নিরাপত্তা চিহ্ন (Safety Marks) আছে কিনা তা যাচাই করুন। যদিও কিছু অসাধু প্রস্তুতকারক নকল চিহ্ন ব্যবহার করতে পারে, তবুও এগুলি একটি প্রাথমিক নির্দেশক।

 

২. ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান:

 

সস্তা চীনা খেলনাতে প্রায়শই এমন কিছু ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান পাওয়া যায় যা শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। শিশুরা খেলনা মুখে দেয় বা খেলার সময় সেগুলোর সংস্পর্শে আসে, ফলে এই রাসায়নিকগুলো তাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে।

সাধারণত যেসব ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান পাওয়া যায়:

  • সীসা (Lead): রঙে বা প্লাস্টিকের খেলনায় সীসা ব্যবহার করা হতে পারে, যা শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ, স্নায়ুতন্ত্র এবং আচরণগত সমস্যার কারণ হতে পারে। শিশুদের জন্য সীসার কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই।
  • থ্যালেটস (Phthalates): এটি প্লাস্টিককে নরম ও নমনীয় করতে ব্যবহৃত হয় (যেমন টিদিং রিং, পুতুল)। থ্যালেটস হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
  • ক্যাডমিয়াম (Cadmium): সীসার একটি সস্তা বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে ধাতব খেলনা বা ব্যাটারিতে। এটিও মস্তিষ্কের ক্ষতি এবং ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
  • আর্সেনিক (Arsenic), পারদ (Mercury) এবং অ্যান্টিমনি (Antimony): এগুলিও কিছু সস্তা খেলনায় বিপজ্জনক মাত্রায় পাওয়া যেতে পারে।
  • বিসফেনল এ (BPA): স্বচ্ছ প্লাস্টিকে (বিশেষ করে #7 চিহ্নিত প্লাস্টিক) এটি থাকতে পারে, যা হরমোনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

কীভাবে সতর্ক থাকবেন:

  • খেলনা থেকে তীব্র রাসায়নিক গন্ধ এলে সেটি কেনা থেকে বিরত থাকুন।
  • অতিরিক্ত চকচকে বা ঝকঝকে রঙের খেলনা, বিশেষ করে যেগুলোর রঙ উঠে যায়, সেগুলো থেকে সতর্ক থাকুন।
  • প্লাস্টিকের খেলনা কেনার সময় #3 বা ‘V’ চিহ্নযুক্ত PVC প্লাস্টিক এড়িয়ে চলুন। এর বদলে #1, #2, #4, এবং #5 চিহ্নিত প্লাস্টিকের খেলনা বেছে নিতে পারেন।

 

৩. মান নিয়ন্ত্রণ এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া (Quality Control and Manufacturing Process):

 

চীনা কারখানাগুলো উচ্চ মানের খেলনা তৈরি করতে সক্ষম, যদি তারা কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে। কিন্তু কিছু ছোট বা অসাধু প্রস্তুতকারক সস্তায় পণ্য তৈরির জন্য মানদণ্ড উপেক্ষা করে।

খেলনা কেনার আগে যা দেখবেন:

  • ব্র্যান্ড এবং উৎপাদকের তথ্য: খেলনার প্যাকেজিংয়ে উৎপাদক বা আমদানিকারকের নাম, ঠিকানা এবং যোগাযোগের বিস্তারিত তথ্য আছে কিনা দেখুন। অজানা উৎস থেকে কেনা খেলনা এড়িয়ে চলুন।
  • ট্র্যাকিং লেবেল: কিছু দেশের নিয়মানুসারে, খেলনায় একটি ট্র্যাকিং লেবেল থাকতে হয় যেখানে প্রস্তুতকারকের নাম, উৎপাদনের তারিখ ও স্থান এবং ব্যাচ নম্বর উল্লেখ থাকে। এটি পণ্যের উৎস শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
  • বয়স নির্দেশিকা: খেলনার প্যাকেজিংয়ে সঠিক বয়স নির্দেশিকা (যেমন: ‘3 বছরের নিচের শিশুদের জন্য নয়’) দেওয়া আছে কিনা, তা খেয়াল করুন। ছোট অংশযুক্ত খেলনা ছোট শিশুদের জন্য শ্বাসরোধের কারণ হতে পারে।
  • আকৃতি ও আকার: খেলনার ছোট ছোট অংশ আছে কিনা, যা শিশুরা গিলে ফেলতে পারে, তা পরীক্ষা করুন। বিশেষ করে 3 বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য ‘Small Parts Regulation’ মেনে চলা খেলনা বেছে নিন।
  • দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব: খেলনাটি মজবুত কিনা এবং সহজে ভেঙে যাবে কিনা, তা যাচাই করুন। ভঙ্গুর খেলনা শিশুদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।

উপসংহার:

চীন থেকে আমদানি করা সব খেলনাই অনিরাপদ নয়। অনেক চীনা প্রস্তুতকারক আন্তর্জাতিক মানের খেলনা তৈরি করে থাকে। তবে, সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি। কেনার আগে একটু যাচাই-বাছাই করলে আপনি আপনার সন্তানের জন্য নিরাপদ এবং মানসম্মত খেলনা নিশ্চিত করতে পারবেন। মনে রাখবেন, আপনার শিশুর নিরাপত্তা সবার আগে।

Write a Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Item 0.00৳ 
Loadding...